Thursday, December 8, 2011

অপ্রকাশিত



পড়ার টেবিলে বসে ছোট ভাইয়ের জন্য কেনা উপহারগুলো দেখছিলাম।
যার সাথে বন্ধুর মতো কেটেছে আমার শৈশব ও কৈশোরের স্বপ্নময় দিনগুলি, সেই সহোদর ভাই আগামীকাল রাত ৯: ০০ ঘটিকায় আমাকে ছেড়ে চলে যাবে সুদূর ইতালীতে পড়াশোনার জন্য। অনুভব করতে পারছিলাম প্রিয়জনদের কাছ থেকে দূরে থাকার কষ্ট।

হঠাৎ টেবিলে থাকা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। ফোনটা রিসিভ করতেই আতংকিত কন্ঠ: “রনি ভাই তাড়াতাড়ি সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে আসেন।”

ঘটনা সম্পর্কে অবগত হতে এক বড় ভাইকে ফোন করে জানতে পারি জনৈক এক ছাত্রনেতার নেতৃত্বে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে মেরে আহত অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

ক্যাম্পাসের একই সাংস্কৃতিক সংগঠনে জড়িত থাকার প্রেক্ষিতে উক্ত ছাত্র আমার খুবই আদরের ছোট ভাই হিসেবে পরিচিত। দ্রুততার সাথে আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দিই।

হল থেকে কিছুদুর অগ্রসর হতেই উক্ত ছাত্রনেতার আনুমানিক ৩০-৪০ জন সমর্থককে হাতে হকি, রড, রামদা ও লাঠি সহ দাড়িয়ে থাকতে দেখে সামনের দিকে অগ্রসর হবো কিনা ভাবছিলাম। কিছু বুঝে উঠার আগেই উক্ত নেতার “বীর সেনানী”রা আমার উপর ক্রমাগত আঘাত করতে থাকে। মুহুর্তের মধ্যেই আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তাতেও বন্ধ হয়নি তাদের পৈশাচিকতা, চলতে থাকে আমার জ্ঞান থাকা পর্যন্ত। জ্ঞান ফেরার পর নিজেকে পঙ্গু হাসপাতালের জরুরী অপারেশর ওয়ার্ডের বিছানায় দেখতে পাই। কিছুক্ষনের মধ্যেই আবার জ্ঞান হারাই। দ্বিতীয়বার জ্ঞান ফেরার পর আমি আমার ডান পায়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারিছলাম না। ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারি আমার পায়ের হাটুর নিচের অংশে লোহার রড জাতীয় কিছু ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রচন্ড ঘৃণা হচ্ছিল তখন নিজেকে একজন ছাত্র হিসেবে কল্পনা করতে।”

উপরোক্ত ঘটনাটি হচ্ছে গত ০৪/১২/২০১১ খ্রিষ্টাব্দে শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা। আমি মোঃ ওবায়দুর রহমান (রনি) সেই ঘটনার শিকার হয়ে আজ পঙ্গু হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি।

আমি জানি আমার এ যন্ত্রণার কান্নার শব্দ হয়তো প্রশাসনের কান পর্যন্ত পৌঁছবে না। কারন আমি কোন রাজনৈতিক সংগঠনের পদবী প্রাপ্ত “ছাত্রনেতা” নই, একজন সাধারণ ছাত্র। একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে শিক্ষা জীবন সমাপ্ত করার লক্ষ নিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম।

আমার বাবা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন সেনা সদস্য হওয়ার কারণে আমার শিক্ষা জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে সেনানিবাসের রাজনীতিমুক্ত পরিবেশে। আমার বাবা তার সেনাজীবনের অনেকটা সময়ই কাটিয়েছেন জাতিসংঘের অধীনে পরিচালিত বিভিন্ন সমস্যা কবলিত দেশের মানুষের শান্তি ও নিরাপত্ত্বা রক্ষার কাজে। তিনি হয়ত কখনোই চিন্তা করেননি যে তার নিজের ছেলেকেই এমন বর্বরতার শিকার হয়ে হাসপাতালের বিছানায় দেখতে হবে, যে বর্বরতা ঐ সকল সমস্যা কবলিত দেশের বর্বরতাকে ও হার মানায়।

যে ভাইয়ের সাথে বন্ধুর মতো ছিলো সম্পর্ক তাকে কেন প্রবাস জীবনে যাওয়ার পূর্বে আমার কাছ থেকে বিদায় নিতে হলো হাসপাতালের বিছানা থেকে? কেন আমার ছোট বোন কান্নায় অশ্রুসিক্ত হয়ে বলতে হবে “ভাইয়া চলো বাসায় চলে যাই, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তোমাকে আর পড়তে হবে না”?

আমার আপনজনদের এই কান্নার শব্দও হয়তো প্রশাসনের কান পর্যন্ত পৌঁছবে না।

উক্ত ঘটনার বিচার চাওয়ার মত “দুঃসাহস” আমার নেই। তারপরও এমন বর্বরতার শিকার যেন ভবিষ্যতে আর কোন শিক্ষার্থীকে না হতে হয় তার কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে আমি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষকমন্ডলী, কৃষিবিদ নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-নেতৃবৃন্দ ও সর্বোপরি সকল সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতি বিনীত আবেদন জানাচ্ছি।



মোঃ ওবায়দুর রহমান (রনি)
সভাপতিঃ “নীলিমা”
সাহিত্য ও প্রকাশনা সংগঠন
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা-১২০৭


__________________________​______________




পঙ্গু হাসপাতালের বেডে শুয়ে অতি কষ্টে রনি এই কথাগুলো আমায় বলেছে আর আমি লিখেছি। তার কষ্ট হচ্ছিলো বলতে।আর আমার কষ্ট হচ্ছিলো লিখতে। শুধু আমি না, যে-ই তার সামনে গিয়েছে কেউ পারেনি অশ্রুজল ধরে রাখতে। পারেননি আমাদের উপাচার্য মহোদয়, পারেন নি আমাদের গন্যমান্য শিক্ষকগন।

ক্যাম্পাসের সদা হাসোজ্জল, সাংস্কৃতিক ছেলে হিসেবে এক নামে যার পরিচয় তাকে এভাবে হাসপাতালের বিছানায় কাতরাতে দেখে কারো পক্ষে অশ্রুজল সংবরন করা আসলেই কষ্টকর।

কিন্তু কি তার অপরাধ?

তার অপরাধ একটাই ... তার জনপ্রিয়তা, তার সাহায্যপরায়নতা।

ক্যম্পাসের নতুন বছরের ভর্তি কার্যক্রম চলছে। প্রতিদিন সকালেই রনি প্রশাসনিক ভবনের সামনে গিয়ে অবস্থান করতো নতুন ভর্তিচ্ছুদের সহায়তা করার জন্যে। আর এই জন্যই ক্ষমতাশীল নেতৃত্বস্থানীয়দের মনে ভীতি ঢুকে যায় রাজনৈতিক ছেলে হারানোর আশংকায়। আর এরই ফল আজ তার শয্যাশায়ী হওয়া।

আমি আজ গিয়েছি তার কাছে...দেখেছি তার দুঃখি মা কে...দেখলাম তার অসহায় বোন কে। তাদের অনেক বলা হলো মামলা করার জন্যে। তাঁরা কিছুতেই রাজি হচ্ছেন না। বলছেন অযথা ঝামেলায় জড়িয়ে আর কি হবে।

আসলেই...আমরাও জানি না কি হবে? কিছুই হবে না। ২-৩ দিন একটু উত্তাল থাকবে পরিবেশ, আজ বাদে কাল ক্ষমতাশীল নেতারা সব তাদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে যাবে...পরশু আবার মার খাবে তার মতো আরেক নিরীহ ছাত্র। অপরাধ একটাই...ছাত্র নেতা না হওয়া।

১ম আপডেটঃ

প্রক্টর স্যার, প্রভোস্ট স্যার এর সুপারিশ নিয়ে উপাচার্য মহোদয় বরাবর আমরা কতক সাধারন ছাত্র আজ বিচারের দাবিতে লিখিত দাবী জানিয়েছি।তখনো ঠিক পিছন থেকেই হুমকি দিচ্ছিলো সেই জনৈক ছাত্রনেতা।

২য় আপডেটঃ

১/ সেই ছাত্রনেতার হুমকির নিচে দাঁড়িয়ে আমরা সাধারন ছাত্র-ছাত্রীরা চালিয়ে যাচ্ছি আমাদের সংগ্রাম। প্রশাসন মহলের সকল স্তরে ব্যাপারটা জানানো হয়েছে। তারা সবাই এর ব্যাবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিয়েছে (জানিনা এর সফলতার সম্ভাবনা কতটুকু)

২/ ১০০০ লিফলেট বিলি করা হয়েছে ক্যাম্পাসের সকল আবাসিক হলে। পুরো ইউনিভার্সিটির সবাই এখন বিষয়টি নিয়ে সোচ্চার।

৩/ ছাত্রনেতা র সমর্থিত চ্যালারা রনির নামে মিথ্যা অপবাদ ছড়ানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সফল হচ্ছে না, কারন রনি কেমন সেটা সবাই জানে।

৪/ কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশনের সকল নেতা-কর্মী সহ ছাত্রলীগের সিনিয়র নেত্রীবৃন্দদের কাছেও ব্যাপারটা এখন অনেক গুরুত্বপূর্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

৫/ ছাত্রনেতার চ্যালারা আজ ক্যাম্পাসে বীরদর্পে টহল দিচ্ছে। আমরা সাধারন ছাত্রছাত্রীরা আজ সারাদিন আতংকে ছিলাম, জানি না কখন আমাদের উপর হামলা চলে এসে এই প্রতিবাদের দোষে! ক্যাম্পাসের অবস্থা থমথমে। হয়তো আর বেশিক্ষন পারবো না টিকে থাকতে।
হয়তো কিছুক্ষন পর আমাকেও থাকতে হবে পঙ্গু হাসপাতালে নয় পরপারে।

দোয়া করবেন আল্লাহ তায়ালা যেনো রক্ষা করেন আমাদের।

__________________________​________________

No comments:

Post a Comment